বাংলাদেশ এখন কোন পথে? আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন?
বদরুদ্দীন উমর: যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, এটা কোনো সামাজিক বিপ্লব নয়। তবে এর মাধ্যমে একটা বড় পরিবর্তন ঘটেছে। একটা ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট সরকার, যা অক্টোপাসের মতো দেশকে আঁকড়ে ধরেছিল, সেটা সরানো গেছে। এটা এই আন্দোলনের একটা বড় অর্জন।
তবে এই সংগ্রামের কোনো শ্রেণি-ভিত্তি নেই। এটা কোনো শ্রেণি-সংগ্রাম ছিল না। শুধু নিপীড়নমূলক এক সরকারকে সরিয়েছে। যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন ছিল না। ছাত্রদের মধ্যে গভীর তত্ত্বগত বোঝাপড়াও তেমন ছিল না।
তবে তো তাঁরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন?
বদরুদ্দীন উমর: তারা সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। কিন্তু কোটার বৈষম্য আর সামগ্রিক সামাজিক বৈষম্য এক জিনিস নয়। অনেকেই ভুল করে এই দুটোকে এক করে ফেলেছে। তাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন বলতে তারা আসলে কী বোঝায়, সেই ব্যাখ্যা আজও পরিষ্কার নয়।
কোটার বৈষম্য নিয়ে তারা কথা বলেছে, ঠিক আছে। কিন্তু সামগ্রিক বৈষম্য বলতে তারা কী বোঝায়? এখনো তাদের দেশের কৃষক-শ্রমিকদের পক্ষে সরাসরি কোনো কথা বলতে শুনিনি। ছাত্ররা বলছে, তারা বামপন্থীও না, দক্ষিণপন্থীও না, তারা মধ্যপন্থী। কিন্তু বাস্তবে ‘মধ্যপন্থী’ বলে কিছু হয় না। তাদের তো বলতে হবে, তারা কী আদর্শে বিশ্বাসী, কোন লক্ষ্য নিয়ে দল করছে। সেটা এখনো স্পষ্ট নয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান থেকে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে নতুন দল গঠিত হয়েছে। এটা কীভাবে দেখছেন?
বদরুদ্দীন উমর: তাদের কার্যকলাপ দেখে আমার কাছে বিষয়টি একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে। বড় আয়োজন করে দল গঠন করেছে, ইফতার পার্টি দিয়েছে, বড় বড় হোটেলে অনুষ্ঠান করেছে। এতে তাদের জনসম্পৃক্ততার বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে।
তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় না, তারা খুব বড় কিছু করতে পারবে। ভবিষ্যতে কী করবে, সেটা দেখা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত তাদের পারফরম্যান্স দেখে বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা দেখি না।
তারা সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলছে, কিন্তু কী পরিবর্তন চায়, কেন চায়—সেটা পরিষ্কার নয়। কোনো ঘোষণাপত্র বা গঠনতন্ত্রও নেই এখনো। শুধু বলছে ক্ষমতায় যাবে, নির্বাচন করবে। কিন্তু মানুষের সমর্থন আদায় করার মতো কোনো শক্ত ভিত তাদের নেই, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। শহরের কিছু জায়গায় হয়তো পরিচিতি আছে, তবে তা খুব সীমিত। নির্বাচনে বড় জয় আসবে, এমনটা মনে করি না।
অন্তর্বর্তী সরকার আট মাস চলছে। এ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
বদরুদ্দীন উমর: এই সরকার নিজে থেকে আসেনি। ছাত্রনেতা ও সাধারণ মানুষের দাবিতে তারা দায়িত্ব নিয়েছে। হাসিনার পতনের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেটা দ্রুত পূরণ করা জরুরি ছিল। নাহলে সামরিক বাহিনী সেই শূন্যতা পূরণ করত, আর দেশে সামরিক শাসন আসত।
তাই যারা বলে, এই সরকার ক্ষমতা দখল করেছে, তারা বাস্তবতা বোঝে না। এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে। তবে তারা কোনো শ্রেণি-ভিত্তিক সরকার নয়। এখনো ব্যবসায়ী শ্রেণিই আসল নিয়ন্ত্রণে। সংসদের ৭০% সদস্য ব্যবসায়ী। রাজনীতিবিদদের সরিয়ে এখন ব্যবসায়ীরাই সরাসরি দেশ চালাচ্ছে।
হাসিনা হয়তো ভাবতেন তিনিই সবচেয়ে ক্ষমতাধর। বাস্তবে পর্দার আড়ালে ক্ষমতার মালিকরা থেকেই গেছেন। প্রশাসন, পুলিশ, অর্থনীতি—সবকিছু এখনো তাদের হাতেই।
এই সরকারের শক্তি সীমিত। তবে তারা একটা বড় নৈরাজ্য এড়াতে পেরেছে, এটা অবশ্যই তাদের অর্জন। ভুলত্রুটি আছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা সফল হয়েছে।
শ্রমিকেরা মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন করলেও ফলাফল কেমন?
বদরুদ্দীন উমর: সরকার শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়ায়নি। কারণ, তারা ব্যবসায়ী শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনেও সরকার কার্যকর সমর্থন দেয়নি।
তবে সামগ্রিকভাবে দেখলে, দেশে যে বিশাল নৈরাজ্য হতে পারত, সেটা হয়নি। বিশৃঙ্খলা কিছুটা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা ভয়াবহ রূপ নেয়নি। এটা অন্তর্বর্তী সরকারের একটি ইতিবাচক দিক।
আমি বাস্তববাদী। সরকারের সমালোচনা করি, কিন্তু বাস্তবতা মেনে। ফিন্যান্স, ব্যাংকিংসহ অনেক জায়গায় তারা মোটামুটি স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে এনেছে। এটা না হলে অবস্থা আরো খারাপ হতে পারত।
এখন সরকারের প্রধান করণীয় কী?
বদরুদ্দীন উমর: তারা আপাতত স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পালন করেছে। এখন দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। আমি মনে করি, এ বছরের মধ্যেই তাদের কাজ শেষ করা উচিত।
সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করা উচিত হবে না। নির্বাচন দিয়ে জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। নির্বাচিত সরকার হয়তো সব সমস্যার সমাধান করবে না, কিন্তু তাদের একটা বৈধতা থাকবে, যা দিয়ে তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে।
অস্থায়ী সরকার বেশি দিন থাকলে নানা বিশৃঙ্খলার ঝুঁকি বাড়বে। কমিশনের রিপোর্টও নির্বাচিত সরকারকে কাজে লাগাতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সব ধরনের সংস্কার করা সম্ভব নয়। তাই তাদের এখনই নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা উচিত।
0 comments: