বিশেষ প্রতিনিধি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে এক ঐতিহাসিক জয় পেয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির।
এ বিজয়ে জামায়াতের রাজনীতিতে বা আগামী জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, এ নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
নির্বাচনে ভিপি, জিএস, এজিএসের পাশাপাশি ডাকসুর ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতে ছাত্রশিবির–সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা জয়ী হন।
অন্যদিকে এ নির্বাচনে বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে, যা বিএনপির নেতৃত্বকে বিব্রত করেছে।
এখন ভোটের পর ফলাফল ধরে সব মহলেই নানামুখী বিচার-বিশ্লেষণ হচ্ছে যে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বা বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থীরা এত খারাপ করলেন কেন আর ছাত্রশিবির এত বড় বিজয় পেল কীভাবে।
এ বিষয়ে বুধবার বিএনপি ও জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের পাঁচজন নেতাসহ বিভিন্ন দলের নয়জন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের নানা রকম পর্যবেক্ষণ রয়েছে। পাশাপাশি ডাকসুর ফলাফলকে ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য বার্তা হিসেবেও দেখছেন তাঁরা।
বিএনপির নেতারা ডাকসু নির্বাচনে নিজেদের দুর্বলতা যেমন দেখেন, তেমনি প্রতিপক্ষ, অর্থাৎ বিজয়ীদের কৌশলও দেখেন।
তাঁরা মনে করেন, ছাত্রশিবির যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে নির্বাচন করেছে। সে ধরনের প্রস্তুতিতে ছাত্রদলের যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। ডাকসুতে ও হলে ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না।
বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে ১৫-১৬ বছর ছাত্রদল ক্যাম্পাসে সংগঠন করতে পারেনি। অন্যদিকে ছাত্রশিবির পরিচয় গোপন করে অথবা ছাত্রলীগের পরিচয় ধারণ করে ক্যাম্পাসে ছিল।
বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করেন, ছাত্রশিবির নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সমর্থন পেয়েছে। না হয় তারা এত ভোট পেল কীভাবে, সে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয়ের কথাও বলছেন কেউ কেউ। তবে নির্বাচনে ছাত্রদল যে খুব ভালো করবে না, সেটা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব আগেই কিছুটা আঁচ করেছিলেন।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রাতে স্থায়ী কমিটির সভায় ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নেতারা আলোচনা করেন। সেখানে ছাত্রদল যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেশ পিছিয়ে, তা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব অবহিত হন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে, ছাত্রশিবির নামে কোনো সংগঠন ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তারা ভিন্ন নামে বা মোর্চায় অংশ নিয়েছে।
এখন তারা নিজস্ব ক্যাপাসিটিতে, নাকি ছাত্রলীগের ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছে, সেটা অ্যানালাইসিস করে আমাদের বের করে দেখতে হবে। তবু গণতন্ত্রের এই যাত্রায় আমরা বিজয়ীদের অভিনন্দন জানাই।’
জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব পড়বে?
এদিকে প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ সাফল্যে বেশ উচ্ছ্বসিত জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।
দলটির নেতারা বলছেন, ছাত্রশিবিরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ভোটের এত ব্যবধান হবে, সেটা তাঁরা ভাবেননি।
বিশেষ করে ছাত্রীদের এত ভোট পাওয়া তাঁদের প্রত্যাশার বাইরে ছিল। নির্বাচনের এই ফলাফল জাতীয় নির্বাচনেও নিশ্চিত প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন জামায়াতের নেতারা।
তাঁদের মতে, এই নির্বাচনে রাজনীতিবিদদের জন্য একধরনের সতর্কবাণী এবং দিকনির্দেশনাও আছে। সেটি হচ্ছে পুরোনো রাজনৈতিক চর্চা আর গ্রহণযোগ্য হবে না।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান যুবসমাজ ও ছাত্রসমাজ নীতিহীন ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বিরুদ্ধে।তারা পুরোনো রাজনৈতিক চর্চা পছন্দ করছে না। তারা গঠনমূলক, মেধাভিত্তিক, একাডেমিক রাজনীতি চায়।
তারা বাংলাদেশে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন চায়। ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্ররা রাজনৈতিক দলগুলোকে সেই বার্তাই দিয়েছে বলে আমরা মনে করি।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের ডাকসু নির্বাচনকে দলীয়ভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কর্মপরিকল্পনা করে জামায়াত।
এর জন্য দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভোটের দিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা পুরানা পল্টনে জামায়াতের ঢাকা মহানগর কার্যালয়ে থেকে নির্বাচন পরিস্থিতির ওপর নজর রাখেন।

জেন–জিদের ভাবনার প্রতিফলন
এবারের ডাকসু নির্বাচনে প্রশাসনিক কারসাজিসহ নানা অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পাটির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তবে তিনি শিক্ষার্থীদের রায়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন,‘ গণ-অভ্যুত্থান-উত্তর তরুণ প্রজন্ম কী চিন্তাচেতনায় কোন দিকে এগোচ্ছে, সেটাকে বিবেচনা করে আমাদের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নিতে হবে।’
অবশ্য এবারের
ডাকসুর নির্বাচনকে একটি শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর ‘চমৎকার’ নির্বাচন বলছে
প্রায় সব রাজনৈতিক দল। সে কারণে অনেকে মনে করেন, মতের ভিন্নতা থাকলেও সবার
উচিত অতীত সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানানো।
এ বিষয়ে
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, ভোট সুষ্ঠু
হয়নি, গণনায় কারচুপি হয়েছে; এটা বলা যাবে না। ফলাফল মানতে হবে, সবার মানা
উচিত।
তবে এই নির্বাচনে তরুণেরা, যাঁদের ‘জেন–জি’ বলা হয়, তাঁরা রাজনীতি ও রাষ্ট্র নিয়ে কী ভাবছেন, তার একটি প্রতিফলন ঘটেছে, যা রাজনৈতিক দলগুলো বিবেচনায় নেয়নি বলে মনে করেন মাহমুদুর রহমান মান্না।
ফ্যাসিবাদী শাসনের ফল
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের অনেকে মনে করছেন, ছাত্রশিবিরের বিরাট বিজয় বিগত সময়ে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের ওপর নিপীড়ন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের ফল। আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ শাসনামলে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ও গুপ্তসংগঠনে পরিণত করেছিল। এই সুযোগে তারা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সংগঠন শক্তিশালী করেছে। ছাত্রলীগ সাজার কৌশলও অবলম্বন করেছিল।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ ও রাজাকারের বিভাজন দিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে। তাদের ফ্যাসিবাদী শাসন জামায়াতকে দিয়ে জায়েজ করতে চেয়েছে। তখন কার্যত জামায়াত নিষিদ্ধ সংগঠন ছিল। একদিকে তারা নিপীড়িত হিসেবে সহানুভূতির জায়গা পেয়েছে, অন্যদিকে অপ্রকাশ্যে কাজ করার অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে। এখন সেটার সুবিধা তাদের কাছে গেছে।
ডাকসু নির্বাচনে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের একাংশের গড়া গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতারাও খুব কম ভোট পেয়েছে। কেন এমন হলো, তা নিয়েও নানা আলোচনা চলছে। অনেকে বলছেন, গত এক বছরে নানা বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কেউ কেউ সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সে জায়গায় ছাত্রশিবির ছিল নমনীয় ও সতর্ক। যার ফলশ্রুতিতে আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর ফল তুলে নিয়েছে ছাত্রশিবির।
সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ নামে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনও ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এটি চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের ছাত্রসংগঠন। ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ নির্বাচনে জুলাই চেতনার সঠিক প্রতিফলন হয়েছে। আমরা আশা করি, বিজয়ের এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
সতর্কতার বার্তা নির্বাচনে
ছাত্রদলের খারাপ ফলাফলের বিষয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হকের পর্যবেক্ষণ ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের প্রতি যে আবেগ, ছাত্রদল সেটা ধরতে পারেনি। তারা ছাত্রলীগের পুরোনো বয়ান (মুক্তিযুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষ) নিয়ে হাজির হয়েছে। কিন্তু এ প্রজন্ম কাউকে রাজাকার গালি আর শুনতে চায় না। তারা গঠনমূলক রাজনীতি, মেধাভিত্তিক রাজনীতির চর্চা চায়। ছাত্রদল এই পুরোনো ধারা থেকে বের হতে না পারলে বাংলাদেশে তাদের রাজনীতি করা কঠিন হয়ে যেতে পারে।
ডাকসু নির্বাচনের এই ফলাফল ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটা বার্তা বলেও মনে করছেন রাজনীতিকদের কেউ কেউ। তাঁদের মতে, এখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতে, ‘এই নির্বাচন থেকে ভবিষ্যৎ পথচলার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাসের মাত্রা যাচাইয়ের সুযোগও হলো।