নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রায় এক ঘণ্টা কাঠগড়ায় বিমর্ষ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। আজ সোমবার বিকেলে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) মুস্তাফিজুর রহমান কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা নূরুল হুদার কাছে জানতে চান, তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন কি না?
জবাবে নূরুল হুদা আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমি কোনো শপথ ভঙ্গ করিনি। একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় পাঁচজনকে দিয়ে। একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকেন, বাকি চারজন থাকেন নির্বাচন কমিশনার। একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধায়নে ১৭ লাখ কর্মকর্তা–কর্মচারী কাজ করেন। একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো গ্রামের ভোটসংক্রান্ত সব তথ্য ঢাকায় বসে জানা সম্ভব নয়। প্রতিটি ভোটকেন্দ্র মনিটরিং করার কোনো সুযোগ থাকে না।’
এ পর্যায়ে সিএমএম সাবেক সিইসি নূরুল হুদার উদ্দেশে বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ফেয়ার নির্বাচন করা? তখন নূরুল হুদা আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য অনেক স্টেকহোল্ডার জড়িত থাকে। নির্বাচন আয়োজনের পর রিটার্নিং কর্মকর্তা গেজেট প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশনের আর কিছুই করার থাকে না। বিষয়টি উচ্চ আদালতের ওপর ন্যস্ত থাকে।’
এ পর্যায়ে সিএমএম নূরুল হুদার উদ্দেশে বলেন, নির্বাচনের শিডিউল (তফসিল) ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব কী? জবাবে নূরুল হুদা বলেন, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নির্বাচনের পর গেজেট হলে নির্বাচন কমিশনের আর কোনো ক্ষমতা থাকে না।
এ পর্যায়ে সিএমএম সাবেক এই সিইসির কাছে নির্বাচনের আগে তৎকালীন আইজিপির (পুলিশের মহাপরিদর্শক) ভূমিকা জানতে চান। জবাবে নূরুল হুদা আদালতকে বলেন, ‘২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে সাবেক আইজিপি আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি মনিটরিং করেছিলেন। যে কারণে ওই নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।’
একপর্যায়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে নূরুল হুদা আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, ২০১৮ সালের নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। সেই বিতর্কের দায় নির্বাচন কমিশনের নয়।’
নূরুল হুদার বক্তব্যের পর তাঁর আরেক আইনজীবী ওবায়দুল ইসলাম আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, উনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। উনি পটুয়াখালীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ভীষণ অসুস্থ। তাঁর ডায়াবেটিস রয়েছে।’
নূরুল হুদাসহ আওয়ামী লীগ আমলের সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করে বিএনপি। দুপুরে ওই মামলা হওয়ার পর সন্ধ্যায় একদল লোক ‘মব’ তৈরি করে নূরুল হুদার উত্তরার বাসা থেকে তাঁকে ধরে এনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার পর পুলিশে সোপর্দ করে। আজ পুলিশ ওই মামলায় নূরুল হুদাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত নূরুল হুদার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আদালতের কাঠগড়ায় নূরুল হুদার এক ঘণ্টা
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ কে এম নূরুল হুদার দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে সিএমএম আদালতকক্ষে তোলা হয়। তখন সময় বিকেল ৪টা ১০ মিনিট। কাঠগড়ায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন নূরুল হুদা।
তখন একজন পুলিশ কনস্টেবল তাঁর মাথা থেকে হেলমেটটি খুলে ফেলেন। পরে চশমা পরেন নূরুল হুদা। একজন আইনজীবী জানতে চেয়েছিলেন তিনি কেমন আছেন? জবাবে নূরুল হুদা ঘাড় ডান দিকে ঘুরিয়ে ইঙ্গিত দিলেন, ভালো। এরপর কাঠগড়ায় মুখ ভার করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।
নূরুল হুদাকে কাঠগড়ায় তোলার পাঁচ মিনিট পর ঢাকার সিএমএম মোস্তাফিজুর রহমান এজলাসে আসেন। নূরুল হুদার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্রেপ্তার সাবেক সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য সাবিনা আক্তার তুহিন ও মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়সাল বিপ্লব। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাবিনা আক্তারকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করা হয়। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এরপর দিনের ভোট রাতে করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে করা বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন খানের মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক সিইসি নূরুল হুদার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে শুরু করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটার (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী।

পিপি আদালতকে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অবৈধ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে যে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সাবেক সিইসি নূরুল হুদা। উনি জনগণের হাতে কট হয়েছেন। উনাকে জনগণ ধরে ফেলেছেন।’
নূরুল হুদা জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন অভিযোগ করে পিপি আদালতকে বলেন, ‘সাধারণ মানুষ, যাঁরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁরা এসব ব্যক্তির ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত। ফলে এসব ব্যক্তিকে দেখামাত্রই জনগণ ধরে ফেলছেন।’
পিপি ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ‘মাননীয় আদালত, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে জনগণ নিশিরাতের নির্বাচন বলেই জানেন। নূরুল হুদা হচ্ছেন নিশিরাতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার। উনি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এমন নিশিরাতের নির্বাচন করে উনারা কীভাবে মানুষকে চেহারা দেখান? উনারা এত বড় নির্লজ্জ, এখনো মানুষের মাঝে যান এবং হাসেন।’
এরপর ওমর ওমর ফারুক ফারুকী সাবেক সিইসি নূরুল হুদার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতের কাছে পড়ে শোনাতে থাকেন।
পরে পিপি আদালতকে বলেন, ‘উনি এমনই একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, যিনি ডিসি (জেলা প্রশাসক), ইউএনও (উপজেলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) ও পুলিশকে রাতেই ভোট বাক্স ভরার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন। ভোট গ্রহণ শেষে তাদের বিরিয়ানি খাওয়ান। একটা তামাশার নির্বাচন করে জনগণের কোটি কোটি অর্থ তছরুপ করেছেন।’
এ সময় নূরুল হুদার আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম আদালতের কাছে দাবি করেন, নূরুল হুদা কোনো অপরাধ করেননি। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রসহ দণ্ডবিধির নির্বাচনসংক্রান্ত যেসব অপরাধ সংঘটিত করার অভিযোগ তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, সেগুলো ভিত্তিহীন।
নূরুল হুদার আইনজীবী আদালতকে আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্যের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, নূরুল হুদাকে তাঁরা ১০ দিন রিমান্ডে চেয়েছেন। অথচ যেসব ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেগুলো জামিনযোগ্য ধারা। মামলায় উনার বয়স ৭৭ বছর দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমার মক্কেলের বয়স আরও বেশি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী, একজন অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তি জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন। আমরা মনে করি, উনি জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন।
উচ্চ আদালতের নজির তুলে ধরে আইনজীবী তৌহিদুল বলেন, ‘মাননীয় আদালত, নূরুল হুদার বিরুদ্ধে জাল ভোটের অভিযোগ আনা হয়েছে। উনি তো প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি তো কোনো জাল ভোট দেননি। নির্বাচনসংক্রান্ত অপরাধ সংঘটিত করার যেসব অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, সেগুলোর একটিও তাঁর সঙ্গে যায় না।’
নূরুল হুদার আইনজীবী আদালতকে আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, নূরুল হুদার বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনা হয়েছে। অথচ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারা অনুযায়ী, উনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করার অভিযোগের মামলার জন্য সরকারের পূর্ব অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো অনুমোদন না নিয়ে মামলা করা হয়েছে।’
নূরুল হুদার আইনজীবী বলেন, ‘যেহেতু নূরুল হুদার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রতিটি ধারা জামিনযোগ্য আর জামিনযোগ্য ধারার অপরাধের মামলায় রিমান্ডে নেওয়ার কোনো বিধান নেই বলে আমরা মনে করি। যেহেতু আমরা মনে করছি, মামলা ত্রুটিপূর্ণ, সেহেতু এ মামলায় নূরুল হুদাকে রিমান্ডে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
এসব বক্তব্যের বিরোধিতা করে আদালতে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরেন পিপি ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি আদালতকে বলেন, ‘রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় সরকারের পূর্ব অনুমোদন প্রয়োজন। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মামলায় সরকারের পূর্ব অনুমোদনের কোনো প্রয়োজন নেই। আসামিপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জামিনযোগ্য ধারার অপরাধের মামলায় রিমান্ডে নেওয়ার কোনো বিধান নেই। আসামিপক্ষের এমন বক্তব্য একদম ঠিক নয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা অনুযায়ী, রিমান্ড বলে আইনি কোনো কিছু নেই। আইনে ডিটেইন (আটক রাখা) শব্দটা রয়েছে। আসামিকে পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন আদালত।’
বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে শুনানি শেষ হলে কাঠগড়া থেকে নূরুল হুদাকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এক ঘণ্টা তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুরো সময় তাঁকে ভীষণ বিমর্ষ দেখা যায়।