Tuesday, April 22, 2025

বিশ্বশক্তির দাবার বোর্ডে কি ভারত ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে?

SHARE

 


অবশ্যই! নিচে আপনার দেওয়া লেখাটিকে একই বক্তব্য বজায় রেখে আধুনিক ও প্রাঞ্জল বাংলায় নতুনভাবে লিখলাম:


বিশ্বশক্তির খেলায় ভারত কি ধীরে ধীরে পেছিয়ে পড়ছে?

বছরের পর বছর ধরে বিশ্বঘটনা আর বড় বড় সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইতিহাস যেন একই চক্রে ঘুরে ফিরে আসে।

যুক্তরাষ্ট্র হলো কাজের প্রতীক। তারা আগে কাজ করে, পরে ভাবে। ভালো হোক বা খারাপ—তারা সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বাণিজ্যযুদ্ধ পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্র বারবার দেখিয়েছে, তারা আগে চাল দেয়, পরে হিসাব করে।

এর উল্টো দিক হলো ভারত। আইডিয়ার অভাব নেই, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে বিশ্লেষণ আর বিতর্কের দোলাচলে পড়ে যায়। ফলে পদক্ষেপ নিতে এত দেরি হয় যে অনেক সময় আর কিছুই করা হয় না। স্মার্ট সিটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডর, স্টার্টআপ ইন্ডিয়া বা মেক ইন ইন্ডিয়ার মতো প্রকল্পগুলো ঘোষণার ঝলক দেখালেও পরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় হারিয়ে যায়।

চীন আবার একদম ভিন্ন ধাঁচে চলে। তারা দশকজুড়ে পরিকল্পনা করে, কৌশলে এগোয়, আর যখন কিছু করে, তখন তা গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—শেনজেন শহরকে প্রযুক্তির মক্কায় পরিণত করা কিংবা ডিপসিক নামের এআই অ্যাপ বানিয়ে ওয়াল স্ট্রিটের বাজার থেকে রাতারাতি এক ট্রিলিয়ন ডলার উধাও করে দেওয়া।

এই ভিন্ন ভিন্ন আচরণের ভেতরেই লুকিয়ে আছে একটা গভীর সত্য: কে কীভাবে বিশ্বকে দেখে, তা বোঝা যায় তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধরন দেখেই।

আমেরিকা সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু অনেক সময় খরচ বা পরিণতি নিয়ে ভাবে না। ভারতের আছে বিশাল মেধা আর সম্ভাবনা, কিন্তু ধীরগতি তাদের আটকে দেয়। আর চীনের পরিকল্পিত এগিয়ে চলা তাদের অন্যদের থেকে এগিয়ে রেখেছে।

আজকের বিশ্বে শক্তির পরিমাপ শুধু ট্যাংক বা টাকার অঙ্কে হয় না। সত্যিকারের শক্তি হলো চাপের মুখেও নিজের অবস্থানে দৃঢ় থাকা। ২০০৮ সালে ভারত সেটা দেখিয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দুর্বল এক জোট সরকার চালিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিতে ভারতের স্বার্থ বজায় রেখেছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও তিনি এনপিটিতে স্বাক্ষর করেননি, বরং এনএসজি থেকে ভারতের জন্য একটি ঐতিহাসিক ছাড় আদায় করেছিলেন।

সেই সময়ে তিনি শুধু আন্তর্জাতিক সাফল্যই আনেননি, দেশের ভেতরও প্রবল বিরোধিতার মুখে জয়ী হয়েছিলেন। ওই সাফল্য ছিল ভারতের পারমাণবিক স্বায়ত্তশাসনের বড় মাইলফলক।

কিন্তু আজকের দৃশ্যপট অনেক আলাদা। রাশিয়া ও চীন যখন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে নিজেদের শক্তি ও কৌশল বাড়িয়েছে, ভারত তখন যেন নরম ও আত্মসমর্পণমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল দুর্বল ও অনিশ্চিত। ২০০৮ সালের দৃঢ়তা এখন আর চোখে পড়ে না।

ভারত যেন নিজের বিশাল জনসংখ্যা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সাহসের জায়গায় পিছিয়ে পড়ছে। প্রশ্ন উঠছে, ভারত কি আসলে বিশ্বশক্তির জায়গা থেকে ক্রমশ 'ক্লায়েন্ট স্টেট' বা অনুগত রাষ্ট্রের দিকে হাঁটছে?

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে অভিষেকে আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু মোদিকে নয়—যদিও মোদি বারবার তাঁকে 'ঘনিষ্ঠ বন্ধু' বলে সম্বোধন করতেন। পরে মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও, সফরটা হয়ে দাঁড়ায় কেবল ব্যবসাভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান।

মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের মাত্র দুদিন পর ২২৮ জন ভারতীয়কে মার্কিন বিমানযোগে দেশে ফেরত পাঠানো হয়—হাত-পা বেঁধে! নারী, শিশু, নবজাতক—সবাই ছিল সেই দলে। এই ছবি সারা ভারতে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেয়। এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়, ভারত নিজের তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য যথেষ্ট চাকরি তৈরি করতে পারছে না এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের কথিত 'মিত্রদের' সঙ্গেও বিশেষ আচরণ করে না।

ট্রাম্প প্রশাসনের ভারতনীতি ছিল একেবারে লেনদেনকেন্দ্রিক ও অপমানজনক। শুল্ক বাড়ানো, ভিসা কড়া করা, বাণিজ্যে চাপ সৃষ্টি—সব করেছে যুক্তরাষ্ট্র, বিনিময়ে দিয়েছে সামান্য কিছুই। ভারতকে তারা এখন সমান কৌশলগত অংশীদার নয়, বরং নির্দেশ মানা অনুগত রাষ্ট্র মনে করে।

একসময় ভারত ছিল এক উদীয়মান বিশ্বশক্তি—গণতন্ত্র, বৈচিত্র্য আর চীনের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু মোদির দশ বছরের শাসনে ভারতের সেই উজ্জ্বল ভাবমূর্তি অনেকটাই ম্লান হয়েছে। এখন ভারতের চেহারা যেন অনেকটা ইউক্রেন বা পাকিস্তানের মতো—যাদের বিশাল সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু বাস্তবে বিশ্বমঞ্চে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

ভারতের পতনের পেছনে বড় কারণ হলো গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া। একসময় ভারত ছিল এমন একটি দেশ, যেখানে ভুল হতো, শেখা হতো, আবার ঠিক করা হতো। আজ সেই সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। সরকারের জবাবদিহির অভাব আর ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ভারতের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক বিকাশ থামিয়ে দিয়েছে।

দেশের ভেতরে এখন বেকারত্ব, দুর্নীতি আর দারিদ্র্য সমস্যা তীব্র। যখন চীন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন ভারতে চলছে মন্দির-মসজিদের রাজনৈতিক নাটক।

বিদেশনীতিতেও ভারসাম্য হারিয়েছে ভারত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ না করে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে লাভ হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদে এই নির্ভরতা ভারতের জন্য বিপজ্জনক।

যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণে ভারতকে 'সেকেন্ডারি ট্যারিফ' আরোপের হুমকি দিচ্ছে। রাশিয়া ভারতের বড় জ্বালানি সরবরাহকারী হওয়ায় এটা বড় বিপদ।

সমস্যা হলো, মোদি নেতৃত্বে কথার ঝলক থাকলেও বাস্তবে ফলাফল খুব কম। ভারত আজ এমন এক বাঁকে দাঁড়িয়ে, যেখানে এখনই নিজের অবস্থান বদলাতে না পারলে ভবিষ্যতে অন্যরা তার ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে—একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে নয়, বরং এক ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’ হিসেবেই।

এখনই পরিবর্তনের সময়। নইলে ভারত নিজেকে এমন এক জায়গায় দেখতে পারে, যেখান থেকে ফিরে আসা আর সম্ভব হবে না।

SHARE

Author: verified_user

0 comments: