ডলি জমাদারের পৈতৃক বাড়ি মাগুরায়। বিয়ের পর স্বামীর হাত ধরে চলে আসেন ফরিদপুরে, বসতি গড়েন শহরের 'বান্ধবপল্লি' নামে পরিচিত হরিজনপল্লিতে।
ডলির ডান হাতের কবজিতে ট্যাটু করা ‘গণেশ’ নামটা তাঁর স্বামীর। ৪৫ বছর আগে বিয়ের পর ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলেন এই নবদম্পতি। তখন ছিপছিপে তরুণী ডলি শখ করে করিয়েছিলেন এই ট্যাটু।
আজও বান্ধবপল্লির ঘরের বসার কোণে রাখা আছে ডলি-গণেশের সেই যৌবনের বাঁধানো ছবি। তবে এখন ছবির একজন শুধু স্মৃতি হয়ে আছে — গণেশ জমাদার। ফরিদপুর সদর হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিলেন তিনি। চাকরির মধ্যেই দৃষ্টিশক্তি হারান। এরপর ডলি সেই চাকরির দায়িত্ব নেন, সেটা ছিল আশির দশকের শেষ দিকের গল্প।
তারপর শুরু হয় ডলির জীবনসংগ্রাম — অন্ধ স্বামী, এক ছেলে আর দুই মেয়ের ভরণপোষণ, সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের অভাব-অভিযোগ মেটানোর দায়িত্বও এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। তাদের ছোট্ট দুই কামরার ঘর হয়ে ওঠে বিপদগ্রস্ত আত্মীয়-পরিজনের আশ্রয়।
২ এপ্রিল দুপুরে ফরিদপুরের বান্ধবপল্লিতে গিয়ে দেখা হয় ডলির সঙ্গে। তখন ডলি সদ্য প্রসব করা এক আত্মীয়ার নবজাতককে নিজের নাতির মতো আগলে রেখেছিলেন। ৩৬ বছর ফরিদপুর সদর হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতার কাজ করে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন ডলি। তাঁর সম্মানে বান্ধবপল্লিতে আয়োজন করা হয় এক ব্যতিক্রমী সংবর্ধনা অনুষ্ঠান, যা নিয়ে এখন শহরজুড়ে আলোচনা।
ডলির ইচ্ছে ছিল অবসরের দিনটি স্মরণীয় করে রাখবেন— আপনজন, সুধীজন আর আনন্দময় আয়োজনে। সেই অনুযায়ী তাঁর একমাত্র ছেলে রাজেশ জমাদার আয়োজন করেন 'সুজনমেলা'।
১৪ মার্চ সন্ধ্যায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠান চলে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ প্রায় দেড়শ অতিথির ভিড়ে মুখর ছিল বান্ধবপল্লি।
রাজেশ প্রথম আলোকে বলেন, "মায়ের স্বপ্নপূরণের জন্যই এই আয়োজন। যাঁরা আমাদের আপন ভাবেন, তাঁদেরই ডেকেছিলাম। যারা অবজ্ঞা করে, তাদের ডাকার প্রয়োজন বোধ করিনি।"
অনুষ্ঠানে ছিল খালি গলায় গান গাওয়া, ফলের আপ্যায়ন আর ডলির নিজের হাতে রান্না করা বিরিয়ানি। অতিথিদের তিনি নিজ হাতে উত্তরীয় পরিয়ে দেন। অতিথিরাও তাঁকে ফুলের তোড়া তুলে দেন।
দেশের অনেক জায়গায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের শিশুদের নানা বঞ্চনার খবর শোনা যায়। সেখানে ডলির সংবর্ধনা যেন এক আশার আলো দেখায়।
ডলি বলেন, "ভালোবাসা দিলে ঈশ্বর তার প্রতিদান দেন।"
ফরিদপুরের ইয়াছিন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আলতাফ হোসেন অনুষ্ঠানে প্রথমেই হাজির হয়েছিলেন। তিনি অনুরোধ করেছিলেন গজল ‘হামে কোই গাম নেহি থা, গামে আশিকি ক্যে প্যাহেলে...’ গাইতে। ডলির ছোট ভাই সে অনুরোধ রাখেন।
অলতাফ হোসেন বলেন, "একজন নারী পরিশ্রম করে পরিবার টিকিয়ে রেখেছেন। তাঁর অবসরের স্বপ্ন ছিল আপনজনদের খাওয়ানো। এর পেছনে হয়তো একটা না বলা বেদনার গল্পও আছে।"
সংস্কৃতিকর্মী শরীফ খান বলেন, "যে হাত শহর পরিষ্কার রাখত, সে হাতে ফুল তুলে দিতে পেরে আমরা গর্বিত।"
গোয়ালন্দ রাবেয়া-ইদ্রিছ মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক লিয়াকত হিমু বলেন, "পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ বন্ধ করলে একটা শহরের কী দশা হয়, ভাবা যায়?"
তিনি স্মরণ করান, চার দশক আগে ফরিদপুরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ধর্মঘট শহরকে অচল করে দিয়েছিল। সেই আন্দোলনের স্মৃতি আজও ডলির মনে স্পষ্ট। আন্দোলনের ফলেই তাঁদের চাকরি সরকারীকরণ হয়, নইলে সংসার চালানো কঠিন হতো বলেই মনে করেন তিনি।
বান্ধবপল্লির গল্প
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ফরিদপুরে ইট-পাথরের বাড়ি তৈরির সময় পরিচ্ছন্নতার কাজে নিযুক্ত করা হয় দলিত মানুষদের। ব্রিটিশরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দরিদ্র পরিবারগুলোকে এনে ফরিদপুরে বসতি গড়ায়। কাজের জায়গাতেই তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়। তাঁদের সেবা নেওয়া যেত, ছোঁয়া যেত না।
মহাত্মা গান্ধী তাঁদের নাম দেন 'হরিজন'— ঈশ্বরের সন্তান।
ফরিদপুরে 'সুইপার কলোনি'র নাম হয় 'হরিজনপল্লি'। পরবর্তীতে সুব্রত ভট্টাচার্যের উদ্যোগে পল্লিটির নাম হয় 'বান্ধবপল্লি'।
ডলি 'হেলা' সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁদের পল্লির ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে নজরকাড়া। কাজের ধরনেই হয়তো নিজেদের বাসস্থান ঝকঝকে রাখার প্রতি তাঁদের আলাদা যত্ন।
পল্লির এক কোণে থাকেন প্রয়াত সিপাহি লালের পরিবার। তাঁদের ছোট ছেলে সুভাষ দাস ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে মাস্টার্স করে সুইজারল্যান্ডে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন।
২ এপ্রিল দেখা হয় সুভাষের সঙ্গেও। আপ্যায়নের টানে ডলি আর সুভাষ তাঁকে নিজের ঘরে নিয়ে যান। সুভাষ মুঠোফোনে থাকা ডলির সংবর্ধনার ছবিগুলো দেখান, আর প্রতিশ্রুতি দেন— "বিদেশে গিয়ে আপনাকে ছবি পাঠাব।"
ডলি মাথায় হাত রেখে সুভাষকে আশীর্বাদ করে বললেন, "এই দিন দেখার আশাতেই তো এত কষ্ট সহ্য করেছিলাম।
0 comments: