আলোচনায় শেখ হাসিনার ফিরে আসা ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি
বাংলাদেশে ৫ আগস্ট ছাত্র ও সাধারণ মানুষের অভ্যুত্থানের পর থেকে ঢাকা-দিল্লির মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির কেন্দ্রে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শুক্রবার ব্যাংককে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম বৈঠকে শেখ হাসিনার প্রসঙ্গও উঠে আসে।
অভ্যুত্থানের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে। সেই সঙ্গে সীমান্ত হত্যা, গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি, এবং দ্বিপাক্ষিক নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের—বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের—নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ভারত। দিল্লির বক্তব্য, তারা একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ দেখতে চায়, যেখানে জনগণের মতামতের মূল্য রয়েছে।
এই আলোচনা হয় থাইল্যান্ডের ব্যাংককে সম্মেলনের পর, যেখানে দুই দেশের নেতারা প্রায় ৪০ মিনিট আলোচনা করেন। আলোচনায় উভয় দেশের স্বার্থ ও উদ্বেগের বিষয়গুলো খোলাখুলি উঠে আসে।
বৈঠকের পর বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়, অধ্যাপক ইউনূস ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং দুই দেশের জনগণের কল্যাণে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
নরেন্দ্র মোদি এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখেন, “ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে গঠনমূলক ও জনগণকেন্দ্রিক সম্পর্কের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছি। সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বেগ জানিয়েছি।”
শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গ
ব্যাংককে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আলোচনা হয়েছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়েও। ভারতে বসে তিনি যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, সেগুলো নিয়েও ভারতের নজরে এনেছে বাংলাদেশ।
অধ্যাপক ইউনূস নিজেও প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন এবং বলেন, উনি যেভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে মন্তব্য করছেন, তা ভারতের দেওয়া আতিথেয়তার অপব্যবহার। তিনি মোদিকে অনুরোধ করেন, যেন শেখ হাসিনাকে উসকানিমূলক বক্তব্য থেকে বিরত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে একটি অনুরোধ এসেছে, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলার সময় এটা নয়।”
সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ
বৈঠকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গও গুরুত্ব পায়। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, হিন্দুসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। মোদি আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখবে এবং সব ধরনের হামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করবে।
এর জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, অনেক প্রতিবেদন অতিরঞ্জিত এবং অনেকটাই ভুয়া খবর। তিনি প্রস্তাব দেন, ভারত চাইলে নিজস্ব সাংবাদিক পাঠিয়ে সরেজমিনে ঘটনা যাচাই করতে পারে। তিনি জানান, তাঁর সরকার ইতোমধ্যে ধর্মীয় ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা নজরদারির আওতায় এনেছে এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।
মোদির আহ্বান ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
ভারতের প্রধানমন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ভারত কোনও নির্দিষ্ট দল নয়, বরং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। তিনি অধ্যাপক ইউনূসকে অনুরোধ করেন, যেন এমন বক্তব্য এড়িয়ে চলা হয়, যা দুই দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
নির্বাচন ও গণতন্ত্রের বার্তা
নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত চায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় থাকুক। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নিয়মিত নির্বাচনের গুরুত্ব রয়েছে—এটা সকলেই জানেন। তিনি বলেন, ভারতের অবস্থান সব সময় জনগণের পক্ষে, কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পক্ষে নয়।
সীমান্ত হত্যা বন্ধে একসঙ্গে কাজের আহ্বান
সীমান্তে প্রাণহানির বিষয়টি তুলেছেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়, দুই দেশের বিশ্বাসের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। তাই এই সমস্যা সমাধানে ভারতকে যৌথভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
মোদি জানান, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা কেবল আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায় এবং এ ধরনের ঘটনা ভারতের ভেতরে ঘটে। উভয় দেশ সম্মত হয়েছে, সীমান্তে প্রাণহানি বন্ধে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন...
এই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান, পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন এবং ভারতের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রিসহ অন্য উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন।
0 comments: