আমরা চাই না যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে ছিলেন নাহিদ ইসলাম। পরে উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেন। সম্প্রতি সেই পদ ছেড়ে তিনি নতুন দল, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চালাচ্ছেন। এই দল, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন, চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি সোমবার ডিপ্লোম্যাটের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনি আন্দোলন থেকে সরকারে গেছেন, তারপর রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন এবং আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
নাহিদ ইসলাম: একটি সরকারকে ভেতর থেকে ও বাইরে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা একেবারে ভিন্ন। অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নিয়েছিল, তখন বাংলাদেশে বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং সময় চলছিল। এটি আমার জন্য বড় অভিজ্ঞতা ছিল। সময়ের প্রয়োজন মেনে আমি পদত্যাগ করে মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি। এখন আমি এই অভিজ্ঞতাকে আমার ভবিষ্যত রাজনৈতিক যাত্রায় কাজে লাগাতে পারব, বিশেষ করে যখন সামনে কঠিন পথ অপেক্ষা করছে। একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা আমার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ, তবে আমি এই পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: অন্তর্বর্তী সরকারে দায়িত্ব পালনের সময় আপনারা কতটা সংস্কার করতে পেরেছেন?
নাহিদ ইসলাম: আমার স্বল্প মেয়াদে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছি। ইন্টারনেট কাঠামো নতুনভাবে সাজানো হয়েছে, আইসিটি বিভাগের জন্য সংস্কারের রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে এবং তথ্য প্রবাহ উন্নত করার জন্য নানা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এসব সংস্কারের প্রভাব হয়তো তাড়াতাড়ি দৃশ্যমান হবে না, তবে আমি আত্মবিশ্বাসী যে, এগুলো দীর্ঘমেয়াদে দেশের উপকারে আসবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: এনসিপি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? এটি কি ডানপন্থী না বামপন্থী দল হবে?
নাহিদ ইসলাম: এগুলোর কোনোটাই নয়। এনসিপি একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল, এবং আমরা এই আদর্শ ধরে রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের লক্ষ্য নতুনদের জন্য একটি জায়গা তৈরি করা, বিশেষ করে তরুণদের ও সমাজের সব শ্রেণীর লোকজনকে, যারা দীর্ঘদিন ধরে গতানুগতিক রাজনীতি থেকে বাইরে ছিলেন।
আমাদের লক্ষ্য হলো একটি গণপরিষদ গঠন করে 'সেকেন্ড রিপাবলিক' প্রতিষ্ঠা করা। এই গণপরিষদ থেকে আমরা নতুন একটি সংবিধান প্রবর্তন করতে চাই এবং ক্ষমতার কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে চাই। আমাদের লক্ষ্যকে পরিষ্কার করার জন্য আমরা বিভিন্ন ধারণা খতিয়ে দেখছি এবং মতামত নিচ্ছি।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: অনেকেই বলছেন, এনসিপি ‘কিংস পার্টি’ এবং সরকারের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে। এটা কি সত্যি?
নাহিদ ইসলাম: যদি এনসিপি একটি ‘কিংস পার্টি’ হতো, তাহলে আমি কেন সরকার থেকে পদত্যাগ করলাম? আমি থেকে যেতে পারতাম, আমার পদ ব্যবহার করতে পারতাম এবং সরকারের ভেতর থেকে রাজনীতি করতে পারতাম।
আমরা সরকার থেকে কোনো বিশেষ সুবিধা নিচ্ছি না। শুধু আমাদের অভ্যুত্থানে ভূমিকার কারণে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো থেকে কিছু স্বীকৃতি পেয়েছি। আর অন্তর্বর্তী সরকার একদলীয় সরকার নয়, এতে নানা মতাদর্শের মানুষ আছেন। সুতরাং, সরকার থেকে সব দল একরকম আচরণ পায়।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: এনসিপি কি জামায়াতে ইসলামী ঘনিষ্ঠ? তাদের দাবিগুলো একই রকম মনে হচ্ছে। কি আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, এনসিপি বাংলাদেশের কট্টরপন্থা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে?
নাহিদ ইসলাম: বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি—আমরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার দাবি করছি। এর মানে কী—আমরা সবাই এক বা একে–অপরের ঘনিষ্ঠ? মোটেও না। যদি তা হতো, তবে আমরা একসাথে জোট গঠন করতাম।
এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী দুটি আলাদা দল, তাদের পৃথক পৃথক এজেন্ডা রয়েছে। আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। জামায়াতে ইসলামী আমাদের ঘনিষ্ঠ নয়। আমাদের কিছু দাবি মিলে যেতে পারে, যেমন আমরা সংস্কারের পক্ষপাঁশে, গণপরিষদ গঠনের জন্য এবং কাঠামোগত পরিবর্তনের পক্ষে। কিন্তু মৌলবাদী প্রবণতার বিষয়ে আমাদের কোনো মিল নেই—এমন দাবি মিথ্যা। উদাহরণস্বরূপ, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানকে অনেকেই সন্ত্রাসী আন্দোলন বলেছে, যা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনারা কখন জাতীয় নির্বাচন চান?
নাহিদ ইসলাম: আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হলো পূর্ববর্তী সরকারের অপরাধীদের বিচার, দেশে একটি স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা এবং গণপরিষদ গঠন করা। আমরা সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের পক্ষে, যাতে ফ্যাসিবাদী শাসন আবার ফিরে আসতে না পারে। এজন্য, নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনার নতুন দলের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
নাহিদ ইসলাম: প্রথমত, বাংলাদেশে অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল রয়েছে, যা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কঠিন করে তুলবে, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে সীমিত সময়ের মধ্যে। যদিও নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ এখনও নিশ্চিত নয়, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের মাঝামাঝিতে নির্বাচন হতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শহর ও গ্রামাঞ্চলের রাজনীতি ভিন্নভাবে পরিচালিত হয় এবং এর জন্য ভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োজন। আগামী মাস থেকে আমরা ঢাকার বাইরে প্রচার শুরু করতে যাচ্ছি।
এছাড়া, এটি দেশের জন্য কঠিন সময়, তাই জনগণের দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আমাদের অবশ্যই সক্রিয় থাকতে হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: এনসিপি কোন ধরনের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ গঠনের কথা ভাবছে?
নাহিদ ইসলাম: সেকেন্ড রিপাবলিকের প্রাথমিক দাবি হলো একটি নতুন সংবিধান, এবং এর জন্য একটি গণপরিষদ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এই সংবিধান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার ওপর ভিত্তি করে হবে। আমরা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সীমাহীন ক্ষমতা প্রত্যাহার এবং ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে। আমরা স্বাধীন বিচারব্যবস্থা চাচ্ছি।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: বাংলাদেশের কূটনীতির বিষয়ে এনসিপির অবস্থান কী? দলটি কি দেশকেন্দ্রিক রাজনীতির সঙ্গে থাকবে?
নাহিদ ইসলাম: প্রথমত, আমরা চাই বাংলাদেশ যেকোনো বিদেশি শক্তির আধিপত্যমুক্ত এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ, লাভজনক কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করুক। অতীতে আমরা দেখেছি বিভিন্ন সরকার ভারতীয় প্রভাবের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ভারত বা পাকিস্তানকেন্দ্রিক হতে দেব না। এনসিপি পুরোপুরি বাংলাদেশকেন্দ্রিক থাকবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনার দল কি আওয়ামী লীগকে রাজনীতি বা পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে?
নাহিদ ইসলাম: না, আমরা চাই না আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিক। প্রথমত, তাদের ভেতরে যারা অন্যায় কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের বিচার হওয়া জরুরি।
0 comments: