নিজস্ব প্রতিবেদক
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে সবাই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। পাশাপাশি তাঁরা এ–ও বলেছেন, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারের যাতে দূরত্ব তৈরি না হয়, সে জন্য সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।
রোববার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন যমুনায় দুই দফায় বিভিন্ন দল ও সংগঠনের ১৯ নেতা বৈঠক করেন। পরে রাজনৈতিক নেতারা এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
বৈঠকের পর এক ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে দেশের ভেতরে ও বাইরে।
বিকেলে প্রথম দফায় বৈঠকে অংশ নেন ১০ জন রাজনৈতিক নেতা। তাঁরা হলেন এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ, সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান (মঞ্জু), ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন শিল্প ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, মুক্তিযুদ্ধ ও দুর্যোগবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ও ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন।
এর আগে শনিবার রাতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠকে নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার নিয়ে তিন দলই নিজেদের আগের অবস্থান তুলে ধরেছে।
প্রথম দফায় বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্ভাব্য দূরত্বের বিষয়টি তুলেছেন কেউ কেউ। কেন এমন দূরত্ব তৈরি হবে, সেই প্রশ্ন তোলেন একজন নেতা। দূরত্ব কমাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের নিয়মিত আলাপ-আলোচনার ওপর গুরুত্ব দেন নেতাদের অনেকে। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, সরকারের কোনো কোনো মহল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে চায়। সংবেদনশীল বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন অনেকে। দুই ছাত্র উপদেষ্টার সরকারে থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
বৈঠক শেষে যমুনার সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিভিন্ন দলের নেতারা। প্রধান উপদেষ্টার ডাকে এ বৈঠকে এসেছেন বলে জানান তাঁরা। সবাই অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি সমর্থনের কথাও জানান।
‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্র’
সংবাদ ব্রিফিংয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘অধ্যাপক ইউনূস আলোচনা শুরু করেছেন এ কথা বলে যে আমরা অনেক বড় সংকটের মধ্যে আছি। এ সংকট বলতে তিনি প্রধানত ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদ আমাদের দেশের পরিবর্তনকে একেবারেই স্বীকার করতে চায় না, পারলে আমাদের এক দিনে ধ্বংস করে দিতে চায়। সে জন্য যা যা করা দরকার, সবই তারা করছে—এই ছিল অধ্যাপক ইউনূসের কথা।’ এ জন্য সমগ্র জাতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মান্না বলেন, ‘সমগ্র জাতি চায় না এখন এভাবে অধ্যাপক ইউনূস ক্ষমতার জায়গা থেকে বিদায় নিয়ে নিক। তাহলে আমাদের জন্য সংকটটা বেশি হবে। এ ব্যাপারেও আমরা বলেছি, বেশি করে রাজনৈতিকভাবে তাঁকে যুক্ত হতে হবে, কথা বলতে হবে এবং কী কর্মসূচি তিনি নিতে চাইছেন, সেটা বলতে হবে। নির্বাচনের রোডম্যাপ তাঁর বলা উচিত। তিনি কী রকম করে নির্বাচন করতে চান, তার ডেডলাইন কবে, সে সম্পর্কে তাঁর বলা উচিত।’
এক প্রশ্নের জবাবে মান্না বলেন, ‘অল্প-বেশি সংস্কারের বিষয় নয়, আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। তার জন্য যেটুকু সংস্কার দরকার, সেটুকু করতে হবে।’
‘নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ চাওয়া হয়েছে’
সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বর থেকে জুনের কথা বলা হয়েছে উল্লেখ করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বলেছি, জাতীয় নির্বাচনের একটা নির্দিষ্ট মাস ও সপ্তাহ কিংবা সুনির্দিষ্ট তারিখ বলা যেতে পারে।’ এ ছাড়া এখন স্থানীয় সরকার অগ্রাধিকার নয় বলেও তাঁরা বৈঠকে বলেছেন বলে জানান।
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিয়েছেন, গণহত্যাকারীদের বিচার এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে কাজ, তা সম্পন্ন করেই তাঁকে যেতে হবে। যত বাধা, যত চাপই অধ্যাপক ইউনূসের ওপর থাকুক না কেন, তাঁকে কাজ করে যেতে হবে।’ তিনি বলেন, অনেক ধরনের অনাস্থা তৈরি হচ্ছে, দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে হবে। এ জন্য সবার মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। জনগণ দৃশ্যমান বিচার দেখতে চায়।
সাকি বলেন, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারের যাতে দূরত্ব তৈরি না হয়, সে জন্য সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি বলেন, ঐক্যের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেসব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাজনিত ইস্যু নিয়ে আলোচনা কম হয়েছে। তাঁরা একটি রাজনৈতিক ঐক্য কাউন্সিল গঠনের কথা বলেছেন। আরেকটি বিষয়, জুলাইয়ের স্পিরিট কেবল (চেতনা) একদল ধারণ করে আর অন্যরা জুলাইবিরোধী—এ রকম পরিবেশ তৈরি করা হলে, সেটিও যেন সরকার গুরুত্বের সঙ্গে দেখে।
নির্বাচন কবে, বিতর্কের সমাধান দরকার
সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সাংবাদিকদের বলেছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে সংস্কার দরকার, তা করতে হবে। বেশি সময়ক্ষেপণ করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক বলেন, তাঁরা বৈঠকে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চায়। একই সঙ্গে তাঁরা বলেছেন, সরকারের দলনিরপেক্ষ চরিত্র-বৈশিষ্ট্যটা অনেক ক্ষেত্রে বজায় থাকছে না। তাঁরা সবাইকে সমানভাবে বিচার করা ও দলনিরপেক্ষ চরিত্র-বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখার কথা বলেছেন।
নির্বাচন ডিসেম্বর না জুনে—এ বিতর্কের সমঝোতাভিত্তিক সমাধান চেয়েছেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বৈঠকে বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে যেসব দূরত্ব ও ঘাটতি হয়েছে, তা সংশোধনে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন, সংশোধন, পরিমার্জনসহ জাতীয় ঐক্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে কঠোর কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নির্বাচন, সংস্কার ও ফ্যাসিবাদী খুনিদের বিচারের পথনকশাও দাবি করেন তিনি। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন মজিবুর রহমান।
৯ দল ও সংগঠনের নেতার বৈঠক
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দ্বিতীয় বৈঠকে অংশ নেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার ও হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
পরে সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করতে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। তিনি বলেন, নির্বাচন আয়োজন করা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব, তবে তারও আগে প্রয়োজনীয় ও মৌলিক সংস্কার, ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত করা এ সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই।
প্রধান উপদেষ্টাকে হাল ছেড়ে না দেওয়ার অনুরোধ করেছেন মাওলানা মামুনুল হক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমাদের এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন যে আমরা যদি সবাই তাঁকে সহযোগিতা করি, তাহলে তিনি চলমান এ সংস্কারপ্রক্রিয়া একটি পর্যায়ে নিয়ে দেশ ও জাতিকে একটি গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই তিনি তাঁর দায়িত্ব ক্ষান্ত করবেন। একটি সুন্দর গ্রহণযোগ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন উপহার দিতে চান তিনি।’
হেফাজতে ইসলামের মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবির কথা উল্লেখ করে মামুনুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন যে তিনি এ বিষয়ে সরাসরি তদারকি করবেন।
বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরানোর পরামর্শ
সরকারের যেসব উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তাঁদের সরিয়ে দেওয়া সরকারের জন্য ভালো হবে—এ কথা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন বলে জানান গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক।
সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে নুরুল হক বলেন, ‘সরকার যেন সামরিক বাহিনীসহ পুরো প্রশাসনকে আস্থায় নিয়ে কাজ করে, তাদের সঙ্গে যেন সরকারের একটা ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে...প্রধান উপদেষ্টা সেই বিষয়টা গুরুত্ব দিয়েছেন, যোগাযোগটা আগের চেয়ে আরও যেন আপনার ঘন ঘন হয়।’
আরেকটা যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে: প্রেস সচিব
রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের বিষয়ে তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, ‘বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে দেশের ভেতরে ও বাইরে। যাতে আমরা এগোতে না পারি। যাতে সবকিছু কলাপস হয়ে যায়, আবার যাতে গোলামিতে ফেরত যাই।’
প্রেস সচিব বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন নিয়ে সরকার যে কাজ করছে, তাতে প্রধান উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক নেতারা সমর্থন জানিয়েছেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন, সবাই একসঙ্গে বসাতে তিনি মনে সাহস পেয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা আবারও জানিয়েছেন, নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হবে; ৩০ জুনের পরে যাবে না। এতে রাজনৈতিক দলগুলো সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
0 comments: